Monday, August 22, 2016

মোগল স্থাপত্যকর্ম বিবিচিনি মসজিদ

রগুনার বেতাগী উপজেলা সদর থেকে আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে উত্তর দিকে ১০ কিলোমিটার পথ এগুলেই বিবিচিনি গ্রাম। সেখানে দিগন্তজোড়া সবুজের বর্ণিল আতিথেয়তায় উদ্ভাসিত ভিন্ন এক ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যে উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে মোগল স্থাপত্যকর্ম এই ঐতিহাসিক মসজিদ। এ এক হূদয়ছোঁয়া পরিবেশ, যা ভুলবার নয়, নয় প্রকাশের। দেশের অনেক দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে বিবিচিনি মসজিদ একটি।

ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এ মসজিদকে গোটা দক্ষিণ বাংলার ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই উজ্জ্বল নিদর্শনটি টিকে থাকলেও কালের বিবর্তনে আজ এর ঐতিহ্য অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তবু এর ধ্বংসাবশেষ পুরনো ঐতিহ্য ও শৌর্য বীর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পূর্বে মসজিদটির অনেক জৌলুস ছিল এবং এটি নিয়ে প্রাচীন নানা কিংবদন্তি এখানে প্রচলিত রয়েছে। মসজিদ ঘিরে রয়েছে আরো অনেক অলৌকিক ঘটনার কাহিনী, নানা ইতিহাস।


জানা যায়, মসজিদটির নির্মাতা সাধক নেয়ামত শাহের কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিল রেখে বিবিচিনি গ্রামের নাম রাখা হয়েছে। চিনিবিবি থেকেই বিবিচিনির সৃষ্টি হয়। আরো জানা যায়, তখনকার সময় বিষখালী নদীর পানি ছিল লবণাক্ত। সুপেয় পানির অভাবে জনগণ বহু কষ্ট পেত। নেয়ামত শাহ মানুষের এই কষ্টের কথা অনুভব করে তার সাধকতার আশ্চর্য তসবিহটি বিষখালী নদীতে ধুয়ে দিলে পানি হয়ে যায় সুপেয়। আজো সেই পানি একই অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া সে যুগে সুন্দরবন-সংলগ্ন বিষখালী নদীতে অসংখ্য কুমির ছিল। তার অলৌকিক প্রচেষ্টায় বিবিচিনি-সংলগ্ন বিষখালী নদী এলাকায় কোনো কুমির আসত না। এ কাহিনী এখনো এ এলাকায় প্রচলিত।
নেয়ামতুল্লাহ শিষ্যসহ বজরায় চড়ে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে (তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপে) নোঙ্গর করেন। তখন শাহ সুজার অনুরোধে ওই গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামের সঙ্গে মিল রেখেই বিবিচিনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম নেয়ামতি। এক সময় অঞ্চলটি ছিল মগ-ফিরিঙ্গিদের আবাস্থল। তাদের হামলার প্রতিরোধে মসজিদটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শাহ সুজা মগ ফিরিঙ্গীদের দমনের জন্য ঝালকাঠির সুজাবাদে এক সেনানিবাস গড়ে তোলেন, যা সুজাবাদ কেল্লা নামে পরিচিত।


ওই সময় বিষখালী নদীর পানি ছিল লবণাক্ত। সুপেয় পানির অভাবে মানুষের কষ্ট দেখে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নিজের তসবিহ নদীতে ভিজিয়ে নেন, এতে পনি সুপেয় হয়। আজও পানি একই অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া সে যুগে সুন্দরবন সংলগ্ন এ নদীতে অসংখ্য কুমির ছিল। তার অলৌকিকতার কারণে কুমির আসত না। এমন অনেক কাহিনী আজও প্রচলিত রয়েছে। তার রেশ ধরে এখনো মনোবাসনা পূরণে প্রতিদিন অগণিত নারী-পুরুষ মসজিদে নামাজ আদায় করেন। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য মানতের মালামাল রেখে যান।


দর্শনীয় ও শোভা বর্ধনকারী এ মসজিদ ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের ঘটনা, যা মানুষের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে। শোনা যায়, পূর্বেকার সময় স্বপ্নে প্রাপ্ত দূরবর্তী অনেক লোকজন এ মসজিদ থেকে গুপ্তধন নিয়ে যেত। শুধু তাই নয়, যে যে ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে এখানে আসে, তার অধিকাংশের আশাই নাকি পূর্ণ হয় বলে অসংখ্য মানুষের কাছে শোনা যায়।


মসজিদটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক বিস্ময়কর স্থান হিসেবে গুরুত্ব বহন করে আসছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাংলার অন্যতম মোগল স্থাপত্যশিল্প এবং এলাকার পুরনো দিনের অতীত স্মৃতি ও ঐতিহ্য। সম্রাট শাহজাহানের সময় পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে শাহ নেয়ামতউল্লাহ দিল্লিতে আসেন। এ সময় দিল্লির সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র বঙ্গদেশের সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং কতিপয় শিষ্যসহ বজরায় চড়ে তিনি ইসলাম প্রচার ও ইবাদতের জন্য ভাটির মুলুকে প্রবেশ করেন। শাহ নেয়ামতউল্লাহ বজরায় চড়ে দিল্লি থেকে রওনা হয়ে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে এসে পৌঁছলে বিবিচিনিতে শাহজাদা বাংলার সুবেদার মোহাম্মদ শাহ সুজার অনুরোধে একই গ্রামে এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিবিচিনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম নেয়ামতি। গ্রামটির নেয়ামত শাহের নামেই রাখা হয়েছে বলে জানা যায়।

সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেয়ালগুলো ছয় ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তর দিকে তিন-তিনটি দরজা রয়েছে। মসজিদের ইটগুলো বর্তমানের মতো নয়। ইটগুলো মোগল আমলের তৈরি ইটের মাপের ন্যায়। যার দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি। সমতল ভূমি হতে মসজিদ নির্মিত স্থানটি আনুমানিক কমপক্ষে ৩০ ফুট সুউচ্চ টিলার ওপর অবস্থিত। তার ওপরেও প্রায় ২৫ ফুট মসজিদ গৃহ।

সাধক নেয়ামতুল্লাহ শাহের কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে বিবিচিনি গ্রামেরও নামকরণ। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাংলার মুঘল স্থাপত্যশিল্প এবং এলাকার পুরনো দিনের নানা স্মৃতি ও ঐতিহ্য। বলা হয়ে থাকে, সম্রাট শাহজাহানের সময় ১৬৫৯ সালে শাহ নেয়ামতুল্লাহ পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে দিল্লিতে আসেন। ওই সময় সম্রাটের দ্বিতীয় ছেলে ও বঙ্গ দেশের সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরে ইসলাম প্রচারে

মসজিদের কাছেই রয়েছে ছোট-বড় তিনটি পুরনো দীঘি। মোগল আমলের এ দীঘি থেকে মানুষ যা চাইত, তা পাওয়া যেত বলে শোনা যায়। মসজিদের নিকটবর্তী বড় দীঘিটি ইছাবিবির দীঘি নামে পরিচিত। তবে বর্তমানে এসব দীঘি বিপন্নপ্রায়। এছাড়া মসজিদের পাশেই রয়েছে তিনটি ব্যতিক্রমধর্মী কবর, কবরগুলো সাধারণ কবরের মতো হলেও লম্বায় ১৪-১৫ হাত। মসজিদের পশ্চিম ও উত্তর পাশে অবস্থিত কবরে শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতউল্লাহ এবং সহোদর চিনিবিবি ও ইছাবিবি। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে নেয়ামত শাহের ইহকাল ত্যাগের পর তাকে এ স্থানে সমাহিত করা হয়।

বিবিচিনির ইতিহাসসমৃদ্ধ মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ দীর্ঘদিন সংস্কারবিহীন থাকার পর প্রায় ১২ বছর পূর্বে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। যদিও সংস্কারের এই উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না। শুধু তাই নয়, নির্দশনটি দেখতে আসার জন্য উপযোগী রাস্তার অভাবে দর্শনার্থীদের ভোগান্তি হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি, অজু ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবহারের ব্যবস্থা নেই।  মসজিদটি প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দিন দিন ধ্বংসের দিকেই যাচ্ছে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী কতিপয় লোক মসজিদের টিলার পাদদেশ কেটে জমি বৃদ্ধি করে চাষাবাদ করছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। বিবিচিনি শাহী মসজিদের উন্নয়নে সরকারের আরো নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং অন্য সবার সচেষ্ট ও উদ্যোগী হওয়া দরকার। টিলার উপরে ওঠার চেষ্টা, অবশেষে উঠে পড়লাম, সুন্দর মনোরম পরিবেশ সত্যি আকুল করে দেয়। উপরে উঠে মনে হলো নদী বেষ্টিত এই জনপদের ছোটখাটো একটি পাহাড়ে উঠেছি, এমন পরিবেশ থেকে মন চায় না চলে যাই কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে তাই বাড়ি ফেরার তাড়া। এগিয়ে যাচ্ছি সাধনার তীর্থস্থান পেছনে ফেলে গুডবাই জানিয়ে, ভাবছিলাম আবার আসব তখন তোমায় দেখব নতুন রূপে অন্য কোনোভাবে।