Friday, August 19, 2016

অপরূপা জাফলং

যদি কেউ এই অভিযোগ করে যে বাংলাদেশে দেখার মত স্থান নেই তবে তার এই অভিযোগের জন্য তাকে শাস্তি দেয়া যায়না বরং তাকে জানিয়ে দেয়া যায় যে আমদের এই দেশটিতে দেখার মতো কী কী আছে। বিশ্বাস করুন যদি আপনি যদি বাংলাদেশ
ভ্রমনে বের হোন তবে বছরেও শেষ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি স্থানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সৌন্দর্য়্যের সমাহার। তেমনই এক নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বাংলাদেশের জাফলং স্থানটি।
জাফলং, বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত, একটি এলাকা। জাফলং, সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, এবং এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত।
প্রকৃতি কন্যা হিসাবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপলীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ইনডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেলপানি,উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদেরদারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে।
এসব দৃশ্যপট দেখতে প্রতিদিনই দেশী-বিদেশীপর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে। প্রকৃতি কন্যা ছাড়াও জাফলং বিউটি স্পট, পিকনিকস্পট, সৌন্দর্যের রাণী- এসব নামেও পর্যটকদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। ভ্রমনপিয়াসীদের কাছে জাফলং এর আকর্ষণই যেন আলাদা। সিলেট ভ্রমনে এসে জাফলং নাগেলে ভ্রমনই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।
জাফলংয়ে শীত ও বর্ষা মওসুমের সৌন্দর্যের রুপ ভিন্ন। বর্ষায় জাফলংএর রুপ লাবণ্য যেন ভিন্ন মাত্রায় ফুটে উঠে। ধূলি ধূসরিত পরিবেশ হয়ে উঠেস্বচ্ছ। স্নিগ্ধ পরিবেশে শ্বাস-নি:শ্বাসে থাকে
ফুরফুরে ভাব। খাসিয়া পাহাড়েরসবুজাভ চূড়ায় তুলার মত মেঘরাজির বিচরণ এবং যখন-তখন অঝোরধারায় বৃষ্টিপাহাড়ি পথ হয়ে উঠে বিপদ সংকুল-সে যেন এক ভিন্ন শিহরণ। সেই সঙ্গে কয়েক হাজারফুট উপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝর্ণাধারার দৃশ্য যে কারোরই নয়ন জুড়ায়।
আবার শীতে অন্য রূপে হাজির হয় জাফলং। চারিদেকে তখন সবুজের সমারোহ, পাহাড় চূড়ায় গহীন অরণ্য। ফলে শীত এবং বর্ষা সব সময়েই বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত স্থান হতে পারে জাফলং। জাফলংয়ের বুক চিড়ে বয়ে গেছে দুই নদী। ধলাই ও পিয়াইন। এই নদী দুইটি অন্যন্যতা এনে দিয়েছে জাফলংকে।
ধলাই ও পিয়াইনের স্বচ্ছ জলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় নানা জাতের ছোট মাছ। দুই নদীর পানির নিচ থেকে ডুব দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিকের পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও মুগ্ধ করে পর্যটকদের। নদীর পানিতে নারী-পুরুষের এই ‘ডুবোখেলা’ দেখা যায় ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি। সীমান্তের ওপারে ডাউকি নদীর উপরে দুই পাহাড়ের মধ্যখানে ঝুলন্ত সেতু বাড়িয়ে তুলেছে জাফলংয়ের সৌন্দর্য। পাহাড়, পানি, পান, পাথর, ঝর্ণা সবমিলিয়ে জাফলং যেনো এক রূপকথার রাজ্য।
নাগরিক জঞ্জাল আর কোলাহল ছেড়ে দু’দণ্ড শান্তি খুঁজে নিতে তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, এমনকি দেশের বাইরে থেকেও দলবেঁধে জাফলংয়ে বেড়াতে আসেন পর্যটকরা। ভাড়া নৌকায় পিয়াইন ও ধলাইর বুকে ভেসে বেড়ান তারা। পাহাড় আর নদীতে সীমাবদ্ধ নয় জাফলংয়ের সৌন্দর্য্য।
জাফলংয়ের সৌন্দর্য্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে সেখানকার আদিবাসীদের জীবনধারা। নদী পার হলেই খাসিয়াপুঞ্জি। খাসিয়াদের গ্রামকে বলা হয় পুঞ্জি। এই পুঞ্জিগুলোতে গেলে দেখা যাবে ৩-৪ ফুট উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি খাসিয়াদের ঘর। প্রতিটি বাড়িতে সৃজিত পানবরজ।
মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া সম্প্রদায়ের পুরুষরা গাছ বেয়ে বরজ থেকে পান পাতা সংগ্রহ করেন। আর বাড়ির উঠোনে বসে নারী সদস্যরা পান পাতা ভাঁজ করে খাঁচা ভর্তি করেন বিক্রির জন্য। পান পাতা সংগ্রহ ও খাঁচা ভর্তি করার অভিনব দৃশ্য পর্যটকদের নজরকাড়ে। পানবরজ ছাড়াও খাসিয়া পল্লীতে দেখা যাবে কমলা বাগান। কাঁচা-পাকা কমলায় নুয়ে আছে বাগানের গাছ। সংগ্রামপুঞ্জির রাস্তা ধরে আরেকটু এগুলো দেখা যাবে দেশের প্রথম সমতল চা বাগান।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীন নির্জনবনভূমি। ১৯৫৪ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যেরঅবসান ঘটে। তারপরও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পতিত পড়ে রয়েছিল। ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌ পথে জাফলং আসতে শুরু করেন।
পাথর ব্যবসারপ্রসার ঘটতে থাকায় গড়ে উঠে নতুন জনবসতিও। আশির দশকে সিলেটের সাথে জাফলং এর ৫৫ কিলোমিটার সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে জাফলংয়ের নয়নাভিরামসৌন্দর্যের কথা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পাশাপাশি প্রকৃতি প্রেমীরাও ভিড় করতে থাকেন জাফলংয়ে।
কয়েক যুগ ধরে জাফলং এলাকা দেশের ২য় বৃহত্তম পর্যটন নগরী হিসাবে দেশ ও বিদেশের ভ্রমন পিপাসুদের কাছে যেমন পরিচিত তেমন সরকারী ভাবেও উল্লেখযোগ্য পর্যটন নগীর হিসাবে খ্যাত। প্রতি বছর ঈদ ছাড়াও প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলার পর্যটক ছাড়াও বিদেশী পর্যটকরাও প্রকৃতি কন্যা জাফলংকে এক নজর দেখতে জাফলং পর্যটন এরিয়া ঘুরে যান। এসব পর্যটকদের আদর আপ্যায়ন করতে গড়ে উঠেছে জাফলং এলাকায় ভিন্ন রকম ব্যবসা বানিজ্য। এতে রয়েছে আবাসিক-অনাবাসিক হোঠেল রেস্তুরা, দেশী-বিদেশী কাপড়-চোপড়ের ব্যাপক পশরা এবং কসমেটিকসহ নানা রকম গিফট সামগ্রী।

যাবেন যেভাবেঃ
সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং এর অবস্থান। সিলেটে থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনায় যাওয়া যায় জাফলংয়ে। সিলেট শহরের যেকোনো অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া যাবে জাফলংয়ে। আর জাফলংমুখী বাস ছাড়ে নগরীর শিবগঞ্জ থেকে। প্রতি এক ঘন্টা পরপর পাওয়া যাবে বাস।
থাকা খাওয়া :
জেলা পরিষদের বাংলো ছাড়া জাফলংয়ে থাকার তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে পর্যটককে থাকতে হবে সিলেট শহরে। আর জাফলং যাওয়ার সময় খাবার সঙ্গে করে নিয়ে গেলেই ভালো হয়। কেননা খাসিয়া আদিবাসী গ্রাম সংগ্রামপুঞ্জিতে একমাত্র ক্যাফে সংগ্রাম ছাড়া জাফলংয়ে নেই কোনো ভালোমানের খাবার রেস্টুরেন্ট। জাফলংয়ের জেলা পরিষদে থাকতে চাইলে সিলেট আসার আগে ফোনে রিসোর্টটি বুকিং নিতে হবে। তবে সিলেটে শহরে থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে। সকল মানের হোটেলই রয়েছে এখানে।