Friday, August 19, 2016

বাংলাদেশের আমাজান - বিস্ময়মাখা স্থানের নাম সিলেটের রাতারগুল

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের এক অন্যতম বিস্ময়মাখা স্থানের নাম সিলেটের রাতারগুল জলার বন। গত কয়েকবছর আগেও মিঠাপানির এ বনটি অপরিচিত ছিল মানুষের
কাছে। গণমাধ্যম-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বনটি সম্পর্কে জানার পর থেকেই মাত্রাতিরক্ত পর্যটকটের আগমন বনের উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
বনের জীববৈচিত্র রক্ষায় এরই মধ্যে এ বনকে ‘বিশেষ জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। সেইসঙ্গে বন সুরক্ষায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে হাতে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ।
সিলেটের রাতারগুলের জলার বন, স্থানীয়ভাবে সিলেটের সুন্দরবন নামেও পরিচিত এ বন। এর অবস্থান সিলেট শহর থেকে আনুমানিক ১৬ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল গ্রামে। সারাবিশ্বে হাতেগোনা যে কয়টি মিঠাপানির জলাবন রয়েছে রাতারগুল তার মধ্যে অন্যতম। সে কারণেই এ বনের প্রতিবেশ বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
বন বিভাগের হিসেব অনুযায়ী জলাবনটিতে ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২০ প্রজাতির সরিসৃপ, ৯ প্রজাতির উভচর এবং ১৭৫ প্রজাতির পাখির অস্বিত্ব রয়েছে।
মাত্র ৩ বছর আগেও এ বন দেশের মানুষের কাছেই ছিল অপরিচিত। তবে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাতারগুলের তথ্য প্রকাশিত হতে থাকলে সেখানে ভিড় জমাতে থাকেন সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকরা।
তবে পর্যটকদের চাপে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে বনের প্রতিবেশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ বনটিকে বিশেষ জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। সেইসঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে বনের প্রতিবেশ রক্ষায় বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ হাতে নেয় বন বিভাগ। এসব পদক্ষেপ বিশেষ প্রকৃতির এই বন সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বলছে, সংবেদনশীল এই বনের পরিবেশ রক্ষার্থে কোনো প্রকল্প নেয়া হলে বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতেই নিতে হবে তা। এ বিষয়ে একমত সরকারের বন
বিভাগও।
রাতারগুল মুলতঃ তিনটি নদীর কাছাকাছি। দক্ষিন দিক থেকে চ্যাঙ্গের খাল এসেছে, পূর্বদিক থেকে কাফনা। চ্যাঙ্গের খাল ও কাফনা মিলে গোয়াইন নাম ধরে চলে গেছে উত্তরে গোয়াইনঘাটের দিকে। বর্ষাকালে এই নদীগুলোর পানি ঢুকে যায় বনের ভেতরে এবং ২০-৩০ ফুট পর্যন্ত পানিবন্দী হয়ে পড়ে পুরো বন। তখন গাছগুলোর অর্ধেক পানির উপর, অর্ধেক পানির নীচে, পানিতে ঘন জঙ্গলের ছায়া সবমিলিয়ে এক অভূতপুর্ব দৃশ্যের অবতারনা হয়। নানা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এই মিঠাপানির জলাবনটিতে উদ্ভিদের দুটো স্তর পরিলক্ষিত হয়। উপরের স্তরটি মূলত বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত যেখানে নিচের স্তরটিতে ঘন পাটিপাতার (মুর্তা) আধিক্য বিদ্যমান । এছাড়াও অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদের আচ্ছাদনে আবৃত । এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তিতে বাংলাদেশ বন বিভাগ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে এখানে। এখন পর্যন্ত এখানে সর্বমোট ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে রয়েছে জারুল, করচ, কদম, বরুণ, পিটালি, হিজল, অর্জুন, ছাতিয়ান, গুটিজাম, বটগাছ, জালি বেত ও মুর্তা বেতসহ পানিসহিষ্ণু বিভিন্য প্রজাতির উদ্ভিদ। জলমগ্ন বলে এই বনে সাঁপের আবাস বেশি, আছে জোঁকও; শুকনো মৌসুমে বেজিও দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে বানর, গুইসাপ; পাখির মধ্যে আছে সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি। শীতকালে রাতারগুলে আগমন ঘটে অতিথি পাখির, আসে বিশালাকায় শকুনও। সাপের মধ্যে রয়েছে অজগর, গোসাপ, গোখরা, শঙ্খচূড়, কেউটে, জলধুড়াসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ গাছের ওপর ওঠে পরে। বনেও দাবিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি, বানর, ভোঁদড়, শিয়াল সহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী।

রাতারগুল বনের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করে যতটানা বর্ণনা করা যায় তার থেকে সেই জলাভূমিয় চড়ে
বেড়ানোটায় অনেক আনন্দঘন এবং রোমাঞ্চকর। রাতারগুল, বনে ঢুকার সাথে সাথে মুখ থেকে উধাও হয়ে যাবে সকল কথা। চোখের সামনে বাকরুদ্ধ করে দেবে সবুজের হাতছানি, দেখতে পাবেন গাছের পাতাদের পানির সাথে লুকোচুরি খেলা, কাকচক্ষুর মতো টলটলে পানি, বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শন শন শব্দের সাথে পানিতে বৈঠা পড়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মিলে তৈরী করেছে শব্দের মায়াজাল। এই চিরসবুজ বনাঞ্চলের কিছু অংশ এতোটাই নিমজ্জিত যে যেখানে নৌকা নিয়ে যাওয়া যায় না। আপনি এই সবুজের চাঁদরে মোড়ানো জলভূমিতে অ্যামাজনের অনুভূতি উপভোগ করতে পারবেন। স্থানীয়ভাবে সুন্দরবন নামে পরিচিত এই জলাবন আপনাকে যেমন ভয় ধরাবে তেমনি স্মৃষ্টি বিস্ময় নিয়েও ভাবাবে। অর্ধ নিমজ্জিত গাছের ডালে ডালে ঝুলে পড়ার অদম্য ইচ্ছাকে অবশ্যই রোধ করতে হবে, কেননা কোন ডাল থেকে যে সর্পমহাশয় ঝুলে বিশ্রাম নিতেছেন তা ঠাহর করা বড় মুশকিল। হিজল, তমাল আর করচ গাছগুলো এখানে এতটাই এঁকে বেঁকে বেড়ে উঠেছে যে আকাশটাও ঢাকা পড়ে যায় গাছের আড়ালে। গাছের সবুজ আর পানিতে সেই সবুজের প্রতিবিম্ব তার উপর সূর্যালোকের লুকচুরি খেলা সবমিলিয়ে এক ভয়াবহ সৌন্দর্য।

নৌকায় করে কিছুদূর গেলে একটি ওয়াচটাওয়ার পাবেন। চেষ্টা করবেন কোথায় ঘুরতে এসেছেন তা একবার পুরোটা উপর থেকে দেখে নেয়ার। নতুবা মাঝির খেলায় বুঝবেন ও না আসলে এটি ৩৩২৫ একরের বাংলাদেশের একমাত্র জলাভূমি এবং বিশ্বের গোটা কয়েক বিশুদ্ধ পানির জলাবনগুলোর একটি। তাই সাবধানে নৌকা ঠিক করে নিবেন। যারা এখনো খুলনার সুন্দরবন দেখেন নি, তাঁরা অনায়াসেই স্বাদ মেটাতে পারেন এই বন দেখে।

রাতারগুল যাওয়ার পথঃ
প্রথম উপায়ঃ সিলেট থেকে জাফলং তামাবিল রোডে সারীঘাট হয়ে সরাসরি গোয়াইনঘাট পৌছানো। এরপর গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে, ভাড়া ৯০০ থেকে ১৫০০ টাকা এর মধ্যে, আর সময় লাগে ২ ঘন্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে ঘন্টা প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নিবে।

দ্বিতীয় উপায়ঃ সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে গোয়াইনঘাট পৌছানো, ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। ওসমানী এয়ারপোর্ট থেকে শালুটিকর হয়ে যাওয়া এই রাস্তাটা বর্ষাকালে খুবই সুন্দর। এরপর একইভাবে গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে, ভাড়া ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা এর মধ্যে আর সময় লাগে ২ ঘন্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে ঘন্টা প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নিবে।

তৃতীয় উপায়ঃ
 সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে মটরঘাট (সাহেব বাজার হয়ে) পৌছাতে হবে, ভাড়া নেবে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আর সময় লাগবে ঘন্টাখানেক। এরপর মটরঘাট থেকে সরাসরি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে চলে যাওয়া যায়, এতে ঘন্টা প্রতি ২০০ টাকা ৩০০ টাকা নিবে। এই তৃতীয় পথটিতেই সময় ও খরচ সবচেয়ে কম।

বনে বা তার আশেপাশে খাবার বা থাকার কোন ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই খাবার গোয়াইনঘাট বা সিলেট থেকে নিয়ে আসা যায়। আরেকটা বিষয়, নৌকায় করে ঘোরার সময় পানিতে হাত না দেয়াই ভালো, জোক সহ বিভিন্ন পোকামাকড় তো আছেই, বিষাক্ত সাপও পানিতে বা গাছে দেখতে পাওয়া যায় অনায়াসেই। আর আছে বানর এবং নাম জানা অজানা অনেক অনেক পাখি।

তবে বনের পরিবেশ নষ্ট করবেন না, আর পলিথিন, বোতল, চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট এইসব জিনিস পানিতে ফেলবেন না দয়া করে। আমাদের নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই।