Friday, August 19, 2016

বিছানাকান্দি - ডুব পাথরে জলের বিছানা

বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের রস্তুমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত বিছানাকান্দি সিলেট জেলার নবীনতম ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে এখন পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। সাদা কালো মেঘের চাদরে ঘেরা চেরাপুঞ্জি আর মেঘালয়ের সবুজ গালিচা পাতা পাহাড়
থেকে নেমে আসা প্রাণবন্ত ঝর্ণার স্রোতস্বিনী জলধারার নিচে বিস্তৃত পাথুরে বিছানায় সজ্জিত অপরূপ সৌন্দর্যের আরেক নাম বিছানাকান্দি। অনেকের মতে গুচ্ছ গুচ্ছ পাথর বিছানো বলেই এর নাম হয়েছে বিছানাকান্দি।

বিছানাকান্দি মুলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সাতটি সুউচ্চ পর্বতের সঙ্গমস্থল যেখানে অনেকগুল ঝরনাধারার পানি একত্রিত হয়ে প্রবল বেগে আছড়ে পরে বাংলাদেশের পিয়াইন নদীতে। পাহাড় থেকে নেমে আসা স্রোতের সাথে বড় বড় পাথর এসে জমা হয় বিছানাকান্দিতে। পিয়াইন নদীর একটি শাখা পাহাড়ের নীচ দিয়ে চলে গেছে ভোলাগঞ্জের দিকে আর একটি শাখা গেছে পাংতুমাই হয়ে জাফলং এর দিকে।

বর্ষার দিনে বিছানাকান্দির পূর্ণ যৌবনে লাভ করে, ভরাট জলে মেলে ধরে তার আসল রূপের বিস্তৃত মায়াজাল। শীতল এই স্রোতধারার স্বর্গীয় বিছানায় আপনি পেতে পারেন প্রকৃতির মনোরম লাবণ্যের স্পর্শ। সুযোগ করে দিতে পারে নগর জীবনের যাবতীয় ক্লান্তি বিসর্জন দিয়ে মনের তৃষ্ণা মেটানোর। দুই পাশে আকাশচুম্বী পাহাড়, তার মাঝে বয়ে চলা ঝরনার স্রোত, পানি একেবারে পরিষ্কার, স্বচ্ছ, এবং টলমলে। স্বচ্ছ শীতল পানির তলদেশে পাথরের পাশাপাশি নিজের শরীরের লোমও দেখা যাবে স্পষ্ট। টলটলে পানিতে অর্ধ ডুবন্ত পাথরে মাথা রেখে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে মন চাইবে। দীর্ঘ সময় জল পাথরের বিছানায় শুয়ে-বসে গোসল আর জলকেলিতে মেতে উঠলেও টের পাবেন না কখন বেলা গড়িয়ে যাবে। এই স্বর্গীয় বিছানা ছেড়ে হয়তো কোন কালেই উঠতে ইচ্ছে করবে না আপনার। কিন্তু বে-রসিক ঘড়ির কাঁটা একসময় জানিয়ে দিবে দুপুর পেড়িয়ে সময় এখন পড়ন্ত বিকেল, ফিরতে হবে আপন নীড়ে।

বিছানাকান্দি যেতে হলে র্সবপ্রথম আপনাকে আসতে হবে সিলেট শহরে। সিলেট নগরীর আম্বরখানা থেকে এয়ারপোর্ট রোড ধরে এগিয়ে গেলে প্রথমেই চোখে পরবে লাক্কাতুরা আর মালনিছরা চা বাগান। রাস্তার দুই পাশ জুড়ে শুধু সবুজ চা গাছের সারি, ওপরে নীল আকাশ আর নীচে যেন সবুজ গালিচা বিছানো। বিমানবন্দর পর্যন্ত এ রকমই সুন্দর রাস্তা দেখতে পাবেন। ছোট ছোট মনোলোভা টিলা পার হয়েই দেখা মিলবে পাথর ভাঙা রাজ্যের। এই রাস্তা ধরে সালুটিকর হয়ে দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন হাদারপার বাজারের কাছে। হাদারপার বাজারে যাবার আগেই মেঘালয়ের সারিবদ্ধ হয়ে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে সীমাহীন উঁচু পাহাড়ের সারি স্বাগত জানাতে জানাতে ধীরে ধীরে যেনো কাছে চলে আসতে থাকবে আপনার। দূর থেকে দেখতে পাবেন পাহারের বুক চিড়ে বয়ে আসা সাদা রেখার ন্যায় অসংখ্য ঝর্না হাতছানি দিয়ে ডাকতে শুরু করেছে নিজেদের দিকে, আর আফসোস করতে থাকবেন ওই সবুজে মোড়ানো সারিবদ্ধ পাহাড় আর ঝর্নাগুলো কেন আমাদের হলো না! এসব ঝরণার কাছে গিয়ে পানি ছোঁয়ার কোনও সুযোগ নেই, শুধুই দুই চোখ ভরে উপভোগ করা যায়। কারণ এর সবগুলোই ভারতের।

হাদারপার খেয়াঘাট থেকে নৌকায় চেঁপে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে বিছানাকান্দির জল পাথরের বিছানার দিকে যতই এগিয়ে যাবেন ততই তার সৌন্দর্যছটা যেন উপচে বের হয়ে আসতে থাকবে। সঙ্গে মিলেমিশে একাকার নদীর এপার আর ওপারের অপার সৌন্দর্য যা আপনাকে দু হাত প্রসারিত করে আলিঙ্গন করবে সব সয়মই। এভাবেই ঠিক পনের মিনিট পর পৌঁছে যাবেন বিছানাকান্দি। দিনটি যদি হয় মেঘাবৃত আকাশ আর বৃষ্টিঝরা, তাহলে আপনি খুবই সৌভাগ্যবান! কারন আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন এখানে আকাশে মেঘের কোলে হেলান দিয়ে পাহাড় যেন ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে।

বিছানাকান্দির এমন সৌন্দর্য বরষা চলে গেলে বা পানি কমে গেলে আর থাকেনা। তখন এটা হয়ে যায় একটা মরুদ্যান। পাথর বহন করার জন্য এখানে চলে অজস্র ট্রাক আর ট্রাকটর। সুতরাং অক্টোবর পর্যন্ত বিছানাকান্দি যাবার মোক্ষম সময়। তবে বর্ষায় পাহাড়ি ঢল থাকে বলে পিয়াইন নদীতে এ সময়ে মূল ধারায় স্রোত অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে, পানির প্রবাহ বেড়ে যায় কয়েকগুন । তাই বিছানাকান্দি যাওয়ার পথে ছোট নৌকা পরিহার করা উচিত। ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে বেড়াতে চেষ্টা করুন। এছাড়া এখানকার নৌকাগুলোতে লাইফ জ্যাকেট থাকে না। তাই যারা সাঁতার জানেন না, সঙ্গে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নিয়ে নিবেন। আর যারা সাঁতার জানেন তারাও সাবধান, কারণ প্রচন্ড স্রোতে আপনি পাথরে আঘাত পেতে পারেন, কারণ মাঝে মাঝে পাথর খুবই পিচ্ছিল।

বিছানাকান্দির বিছানা বাংলাদেশ আর ভারত মিলিয়ে। স্বাভাবিক ভাবে সীমানা চিহ্ণিত করা নেই এখানে। জায়গাটিতে তাই সাবধানে বেড়ানো উচিৎ। বাংলাদেশ অংশ ছেড়ে ভারত অংশে চলে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। তবে দিনটা যদি হয় শুক্র বা সোমবার, তাহলে ভাববেন কপাল খুলে গেছে আপনার। সকাল দশটা থেকে চারটার ভিতর যেতে পারবেন ভারতে, সীমান্তে হাট বসে তখন। খেতে পারবেন ভারতীয় ফলমূল, কেনেকাটা করতে পারবেন রকমারি জিনিসপত্র।

এই বর্ষায় ঘুরে আসুন পাহাড়ি ঝর্না আর ডুব পাথরের জলখেলার দৃশ্যে শোভিত অপরূপ প্রকৃতির অপ্সরা বিছানাকান্দি থেকে, উপভোগ করুন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বন্ধু অথবা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে। হাতে সময় থাকলে নৌকা নিয়ে বিকেলটা কাটিয়ে আসতে পারেন পাংথুমাই ঝর্না আর লক্ষণছড়া থেকে। লিখাটি পড়ে ভালো লাগলে লাইক এবং শেয়ার দিয়ে অপরকে এই সুন্দর জায়গাটি সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিন। 


প্রয়োজনীয় তথ্য

বিছনাকান্দির বিছানা বাংলাদেশ আর ভারত মিলিয়ে। স্বাভাবিকভাবে সীমানা চিহ্নিত করা নেই এখানে। জায়গাটিতে তাই সাবধানে বেড়ানো উচিত। বাংলাদেশ অংশ ছেড়ে ভারত অংশে চলে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। সাঁতার জানা না থাকলে এ ভ্রমণে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নেওয়া উচিত। তাছাড়া ভ্রমণে গিয়ে কোনো বর্জ্য জায়গাটিতে ফেলে আসবেন না। গোয়াইনঘাটের হাদারপাড় থেকে নৌকা নিয়ে প্রথমে দেখতে পারেন পান্তুমাই, তারপরে লক্ষণছড়া এবং শেষে বিছনাকান্দি।
কীভাবে যাবেন
বিছনাকান্দি যেতে প্রথমে যেতে হবে সিলেট শহরে। সড়ক, রেল ও আকাশ পথে ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেটআসতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকেও সিলেটে আসা যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে। এ পথে গ্রিন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া, এস আলম পরিবহন, শ্যামলি পরিবহন ও এনা পরিবহনের এসি বাস চলাচল করে। ভাড়া ৮০০-১১০০ টাকা। এছাড়া শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনের পরিবহনের নন এসি বাস সিলেটে যায়। ভাড়া ৪০০-৪৫০ টাকা। এনা পরিবহনের বাসগুলো মহাখালী থেকে ছেড়ে টঙ্গী ঘোড়াশাল হয়ে সিলেট যায়।
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস । শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৫০-১০১৮ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৪৫-১১৯১ টাকা ।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, নভো এয়ার এবং ইউএস বাংলা এয়ারের বিমান প্রতিদিন যায় সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে ।
সিলেট শহর থেকে অটো রিকশায় প্রথমে আসতে হবে হাদারপাড়। হাদার পাড়ে যাওয়ার সহজ পথটি হলো শহর থেকে মালনিছড়ার পথে ওসমানী বিমানবন্দরের পেছনের ভোলাগঞ্জের সড়ক ধরে। তবে এ সড়কটি বর্তমানে বেহাল। পাথর বোঝাই ট্রাক চলাচলের কারণে রাস্তায় প্রচুর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ পথে সেডান কার কিংবা মাউক্রোবাস নিয়ে যাওয়া দুষ্কর। এ পথে সবচেয়ে সহজ ও সুবিধা হলো অটোরিকশা। সিলেট শহর থেকে হাদারপাড়ের যাওয়া আসার অটো রিকশা ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকা। একটি অটোরিকশায় সর্বোচ্চ ৫ জন যাওয়া যায়। হাদারপাড় বাজারের পোস্ট অফিস ঘাট থেকে জায়গা তিনটি ভ্রমণের পর্যটক নৌকা পাওয়া যায়। ১০-২০ জন চলার উপযোগী একটি নৌকার ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকা।