Monday, August 15, 2016

তিলোত্তমা হাতিয়া - নিঝুম দ্বীপ

তিলোত্তমা হাতিয়া - নিঝুম দ্বীপ

  

সমুদ্রে, নীরবে নিভৃতে, শান্ত স্নিগ্ধ রূপ নিয়ে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় ১৯৪০ এর দশকে ধীরে ধীরে নিঝুম দ্বীপটি জেগে  ওঠে  সেখানে কেওড়া-গেওয়া বনের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া সরু খালের পাড়ে সবুজের আচ্ছাদিত নকশিকাঁথার মাঠে দলবেঁধে হরিণের ছুটে চলা জোয়ারের সময় খালের পাড়ে জলপানের দৃশ্য, ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির ওড়াওড়ি বণে পাখির কিচিরমিচির, বালুচরে চিক চিক মিষ্টি সূর্যরশ্মি, সাগরবক্ষের নৈসর্গিক সৌন্দর্যময় অভয়ারণ্য নিঝুম দ্বীপে শীত মৌসুমজুড়ে প্রকৃতির এমন মায়াবীরূপ প্রতিদিনই উপভোগ্য

নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের একটি ছোট্ট দ্বীপ। নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অর্ন্তগত নিঝুম দ্বীপ। একেদ্বীপবলা হলেও এটি মূলত একটিচর নিঝুম দ্বীপের পূর্ব নাম ছিলো চর-ওসমান। ওসমান নামের একজন বাথানিয়া তার মহিষের বাথান নিয়ে প্রথম নিঝুম দ্বীপে বসত গড়েন। তখন এই নামেই এর নামকরণ হয়েছিলো। পরে হাতিয়ার সাংসদ আমিরুল ইসলাম কালাম এই নাম বদলে নিঝুম দ্বীপ নামকরণ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত কোনো লোকবসতি ছিলো না, তাই দ্বীপটি নিঝুমই ছিলো

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিঝুমদ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন হতে কিছু জেলে পরিবার প্রথম নিঝুমদ্বীপে আসে। নিঝুমদ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ইছা মাছ (চিংড়ি মাছ) ধরা পড়তো বিধায় জেলেরা এই দ্বীপের নাম দেয় ইছামতির দ্বীপ। দ্বীপের মাটি চিকচিকে বালুকাময়, তাই জেলেরা নাম দিলেন বাল্লারচর বা বালুর চর। এই দ্বীপটিতে মাঝে মাঝে বালির ঢিবি বা টিলার মত ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বা বাল্লারচর বলেও ডাকতো। কালক্রমে ইছামতি দ্বীপ নামটি হারিয়ে গেলেও স্থানীয় লোকেরা এখনো এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বা বাল্লারচর বলেই সম্বোধন করে। নিঝুম দ্বীপ বা বাইল্যার ডেইল বা বাল্লারচর যে নামই হোক না কেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের দিয়ারা জরিপ বিভাগ এই দ্বীপের জমি চর ওসমান মৌজা হিসেবে জরিপ করে। কথিত আছে সর্দার ওসমান নামের এক সাহসী বাথানিয়া ১০০ মহিষ নিয়ে প্রমত্তা মেঘনা পাড়ি দিয়ে প্রথম এই দ্বীপে অসে এবং দিয়ারা জরিপ কর্মচারীদেরকে জরিপ কাজে প্রভূত সহায়তা করে বিধায় তার নামে অনুসারে নিঝুম দ্বীপে মৌজার সরকারী নাম হয় চর ওসমান।

৭০ এর ১২ নভেম্বর প্রলয়কারী ঘূর্ণিতে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বিরান হয়ে যায় জনপদ। স্বাধীনতা পর বন বিভাগ এর দায়িত্ব নেয় এবং শুরু করে বনায়ন। সমগ্র নিঝুম দ্বীপের প্রায় ৩০০০.০০ একরে মানুষের বসতি রয়েছে এবং অবশিষ্ট অংশে ম্যানগ্রোভ বনায়ন রয়েছে। ইছামতির দ্বীপ বা বাইল্যার ডেইল বা বাল্লারচর বা চর ওসমান যে নামেই স্থানীয় ভাবে প্রচলিত হোক না কেন১৯৭৪ সালে হাতিয়ার তত্কালীন সাংসদ এবং যুব, ক্রীড়া বন প্রতিমন্ত্রী মরহুম আমিরুল ইসলাম ওরফে কালাম দেশী-বিদেশী পর্যটকদের চর ওসমানে নিয়ে যান এবং অবাক বিষ্ময়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবাই অবলোকন করলেন এর শান্ত স্নিগ্ধ রূপ এবং এই দ্বীপের নাম দিলেন নিঝুম দ্বীপ। সেই থেকে নিঝুম দ্বীপ হিসেবেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে

নিঝুম দ্বীপে এখন হরিণের সংখ্যা ৪০ হাজাররের মত তারপরও হরিণ দেখতে হলে এখানে ভ্রমণকালীন সময়ে কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে বনে ঢুকলে নিঃশব্দে চলাচল করতে হবে সামান্য হৈ চৈ করলে এখানে হরিণের দেখা মেলা দুস্কর জঙ্গলে ট্রেকিং এর সময় যথা সম্ভব সবাই হালকা রঙের সুতি পোশাক পড়বেন বন্য প্রাণীদের দৃষ্টি খুব প্রখর অতি উজ্জ্বল পোশাকের কারণে দূর থেকেই আপনার আগমন টের পেয়ে যাবে ওরা হরিণের দল দেখতে বা ছবি তুলতে চৌধুরী খালের শেষ মাথা ভালো, ওই দিকটায় হরিণ বেশি দেখা যায় ভালো ছবি পেতে চাইলে গভীর জঙ্গলে ঘাপটি মেরে বেশ কিছু সময় বসে থাকতে হবে তবে ভয় নেই বনে বন্য কুকুর ছাড়া হিংস্র কিছু নেই

হরিণ দেখার সবচেয়ে উত্তম স্থান হলো নামারপাড়া সেখানে থাকাই শ্রেয় তবে আরেকটু এ্যাডভেঞ্চার করে হরিণ দেখতে পারেন সরাসরি কেওড়া বনে ঢুকে তবে সাথে কম্পাস না থাকলে বিপদে পড়তে পারেন আর [স্থানীয়দের মতে] দস্যুদের কবলে পড়ার ভয় থাকে কিন্তু দল বেঁধে হৈচৈ করে হরিণদের শান্তি নষ্ট করার মধ্যে নিশ্চয়ই আনন্দ নেই নীরবে, দূর থেকে দেখুন, নীরবেই চলে আসুন

যারা উচ্ছাস উচ্ছলতা আর রোমাঞ্চে জীবনকে অর্থবহ করতে চান তারা নিঝুম দ্বীপকে ঘিরে, সে আশা ষোল কলা পূর্ণ করতে পারেন শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকলেও বছরের যেকোন সময় এখানে আসা যায় এপ্রিল থেকে সাগর ধীরে ধীরে অশান্ত বা গরম হতে থাকে তখন ঢেউয়ের উচ্চতাও বৃদ্ধি পায় ট্রলারেসে তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সাগর পাড়ি দিতে প্রয়োজন পড়ে সাহসের সে সময় এক রোমাঞ্চ অভিজ্ঞতায় দুধর্ষ অভিযাত্রীর মত মনে হবে নিজেকে উদ্দাম ঢেউয়ে ছিটকে আসা সমুদ্রের লোনা জল পুলকিত হবে হৃদয় সময় সমুদ্র পাড়ি হবে জীবনের রোমাঞ্চকর হৃত-কাঁপানো অভিজ্ঞতা

ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সহজ রুটটি হলো- সদরঘাট থেকে লঞ্চে হাতিয়ার তমরুদি পথে দুটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে ভাড়া ডাবল কেবিন ১৫০০ টাকা, সিঙ্গেল ৮০০ টাকা ডেকে জনপ্রতি ২২০ টাকা মত হবে ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকেল সাড়ে টায় আর তমরুদি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে দুপুর সাড়ে বরোটায় তমরশুদ্দি থেকে স্কুটারে বন্দরটিলা ঘাট ভাড়া ৬০০-৬৫০ টাকা মত যাওয়া যাবে /৪জন স্কুটার ছাড়া বাস+রিকসা করে বন্দরটিলা ঘাটে যাওয়া যায় বাস ভাড়া ৩০-৪০ টাকা, রিকসা ভাড়া ৫০-৬০ টাকা বন্দরটলা ঘাট থেকে ট্রলারে চ্যানেল পার হলেই নিজুম দ্বীপের বন্দরটিলা চ্যানেল পার হতে সময় লাগবে ১৫ মিনিট এটা নিঝুম দ্বীপের এক প্রান্ত, আসল গন্তব্য অন্য প্রান্তের নামা বাজার বন্দরটিলা থেকে নামা বাজার যেতে হবে রিকশায় ভাড়া ১৫০-২০০ টাকা মত ক্লান্ত না হয়ে পড়লে ছবি তুলতে তুলতে হেঁটেও যাওয়া যায়

এছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অনেকগুলো চেয়ারকোচ সরাসরি নোয়াখালীতে যাতাযাত করে চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টায় এগুলো সরাসরি মাইজদী সোনাপুর এসে পৌঁছে ভাড়া ২৫০ টাকা মত সকাল সাতটায় কমলাপুর থেকে ছাড়ে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন এছাড়া ঢাকা সাঈদাবাদ থেকে আধা ঘন্টা পর পর যাত্রীসেবা বাস গুলো ছাড়ে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে

নোয়াখালী সোনাপুর পৌঁছে সেখান থেকে যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাট বাস, টেম্পু বা বেবীতে সরাসরি ৪০ কিঃমিঃ দক্ষিণে সুধারামের শেষ প্রান্তে চর মজিদ স্টিমার ঘাট তার পরেই হাতিয়া যাবার চেয়ারম্যান ঘাট সোনাপুর থেকে একটি বেবী রিজার্ভ নিলে ৩০০-৪০০ টাকায় যাওয়া যায় টেম্পো, বাসে জনপ্রতি ভাড়া আরো কম চর মজিদ ঘাট থেকে ট্রলার কিংবা সী-ট্রাকে করে হাতিয়া চ্যানেল পার হয়ে যেতে হবে হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা নলচিরা বাজার থেকে যেতে হবে হাতিয়ার দক্ষিণে জাহাজমারা সময় নেবে আধা ঘন্টা জাহাজমারা থেকে ট্রলারে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ সময় নেবে ৪০-৫০মিনিট তবে দলবেঁধে গেলে ট্রলার রিজার্ভ করে সরাসরি চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায় ঘাট থেকে নদীপথে হাতিয়া অথবা নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে জোয়ারের জন্য

বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে সপ্তাহে তিন দিন B.I.W.T.A. এর স্টীমার এম আলাউদ্দিন, এম. ভি বার আউলিয়া এবং এম. বি মনিরুল হক হাতিয়া নলচিরা ঘাট পর্যন্ত চলাচল করে সকল স্টীমার চট্টগ্রামর সদর ঘাট থেকে সকাল ৯টা যাত্রা শুরু করে একই দিন বিকাল ৪টায় নলচিরা ঘাট পোঁছে হাতিয়া নলচিরা ঘাট থেকে পরদিন সকাল ৯টায় চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করে বিকাল ৫টায় চট্টগ্রাম সদর ঘাট পৌঁছে BIWTC ফোন নং:- ৬১৩৩৫৮, ৬১৭৯৭৬ বর্তমান চট্টগ্রাম হতে হাতিয়ার সাধারণ যাত্রী ভাড়া জনপ্রতি ১০৫টাকা, কেবিন প্রথম শ্রেণী ৬০০টাকা,দ্বিতীয় শ্রেণী ৩০০টাকা

কোথায় থাকবেনঃ

নিঝুম দ্বীপে থাকার জন্য একমাত্র ভালো মানের জায়গা হলো অবকাশ পর্যটনের নিঝুম রির্সোট এখানে শয্যার কক্ষ ভাড়া ১০০০ টাকা, শয্যার কক্ষ ১২০০ টাকা, শয্যার কক্ষ ১৮০০ টাকা, শয্যার ডরমিটরির ভাড়া ১০০০ টাকা, ১২ শয্যার ডরমিটরি ২৪০০ টাকা ঢাকা থেকে রিসর্টের বুকিং দেয়া যায় যোগাযোগঃ অবকাশ পর্যটন লিমিটেড, শামসুদ্দিন ম্যানশন, ১০ম তলা, ১৭ নিউ ইস্কাটন, ঢাকা ফোন- ৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ০১৫৫২৪২০৬০২

এখানকার স্থানীয় বাজারে খুব সস্তায় অল্প দামে চার পাঁচটি আবাসিক বোডিং আছে তাছাড়া বন বিভাগের একটি চমৎকার বাংলো আছে পাশেই আছে জেলা প্রশাসকের ডাক বাংলো এগুলোতে আগে ভাগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায় তাছাড়া রেড-ক্রিসেন্ট ইউনিট সাইক্লোন সেন্টারেও থাকার ব্যবস্থা করা যায়