Friday, August 19, 2016

অপরূপ লোভাছড়া

পাহাড়ের কোলজুড়ে সবুজ গাছপালার ঘন রঙে আচ্ছাদিত হয়ে আছে লোভাছড়া চা বাগান। মাটির রাস্তা ধরে যত দূর এগোনো যায়, চোখে পড়ে ছোট-বড় নানা ধরনের গাছপালা। চা বাগানের
মাঝে গাছগুলো সারি সারি সাজানো। এর সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। কী সুন্দর লোভাছড়া! চারদিক সবুজের সমারোহ। সীমান্তের ওপারে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে যেন। 

দেশের উত্তর-পূর্ব সীমন্তে কানাইঘাট উপজেলায় ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া চা বাগান এবং নানা দর্শনীয় স্থান ঘিরেই লোভাছড়ার অবস্থান। ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, নদী-নালা ও খাল-বিল পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক দর্শনীয় স্থান লোভাছড়া। প্রায় ৫০ বছর আগে নির্মিত টিলাবাবু আর ম্যানেজারের আকর্ষণীয় বাংলো আজো পর্যটকদের বিমোহিত করে। 

লোভাছড়ার চা বাগান রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছ, ঘন সবুজ বনানী প্রাকৃতিক লেক আর স্বচ্ছ পানির ঝরনা এখানে ঘুরতে আসা লোকজনের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এখানকার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে চা বাগান, প্রাকৃতিক লেক ও ঝরনা, ঝুলন্তসেতু, মীরাপিং শাহর মাজার, মোগল রাজা-রানির পুরাকীর্তি, প্রাচীন দীঘি, পাথর কোয়ারি ও বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন ঘুরতে ঘুরতে কখন যে একটা দিন পেরিয়ে যাবে তা বুঝে উঠতে পারবেন না।

এখানকার পাহাড়ের মধ্যবর্তী ঢালু উপত্যকায় রয়েছে অনেক প্রাকৃতিক লেক। পরিচর্যা করলে এ লেকগুলো হয়ে উঠতে পারে আরো আকর্ষণীয়। আয়তনের দিক দিয়ে ছোট হলেও লেকগুলোর স্বচ্ছ পানি দেখে মন জুড়িয়ে যায়। এখানকার ঝরনার পানির ছল ছল শব্দ শুনে পর্যটকদের মন আনন্দে

নেচে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর তাণ্ডবে এই বাগানের নিজস্ব ফ্যাক্টরি ধ্বংস হয়ে যায়। তাই এখানে গেলে কোনো চা প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি দেখা যাবে না বটে, তবে ধ্বংসাবশেষ চা ফ্যাক্টরি আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করবে।

এই চা বাগানের সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতা অন্যদিকে রয়েছে তার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের প্রতি লালসা। লোভাছড়ার পাশ দিয়ে ভারত সীমান্তে হারিয়ে গেছে ‘নুনগাঙ’। ‘নুনগাঙ’ প্রায় নদীর মতো হলেও এটি আসলে ঘোলা পানির একটি খাল যা লোভাছড়া নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। খালের ওপর বেশ পুরনো, তবে এখনো মজবুত স্টিলের তৈরি একটি ব্রিজ রয়েছে। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঝুলন্ত সেতু। সড়ক পথে লোভাছড়ায় আসার পথে পাওয়া যায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই ঝুলন্ত সেতু, স্থানীয়ভাবে যা ‘লটকনির পুল’ নামে পরিচিত। জানা যায়, ১৯২৫ সালে ইংরেজরা লোভাছড়ায় যাতায়াতের জন্য সেতুটি নির্মাণ করে। আকর্ষণীয় এই সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে লোভাছড়ার অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করা সত্যিই অসাধারণ। লোভাছড়ার দক্ষিণ পাশে সুরমা নদী তীরবর্তী মূলাগুল বাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত একটি টিলার ওপর রয়েছে হযরত শাহজালাল(র.)-এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম ওলি হযরত মীরাপিং শাহ (র.)-এর মাজার। মাজারটি দেখার জন্য এখানে প্রতিদিন অনেক ভক্ত এসে ভিড় জমান। ভক্তদের ভালোবাসার শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ে মাজার সংলগ্ন এলাকায়। 

লোভাছড়া সীমান্তে মোগল সাম্রাজ্যের রাজা-রানিদের অনেক পুরাকীর্তি রয়েছে। চোখাটিলা নামক একটি পাহাড়ের পাদদেশে একটি ঝরনার পাশে রয়েছে প্রাচীনকালের দুটি পাথর। এ পাথর দুটিতে বসে রাজা-রানিরা খেলতেন। পাথরে বসে রাজা-রানিরা লোভাছড়ার সৌন্দর্য নিবিড়ভাবে অবলোকন করতেন।

চা বাগানের পাশে রয়েছে একটি বিশাল দীঘি। এককালে দীঘিতে অনেক অলৌকিক জিনিসপত্র যেমন, থালা-বাসন, রৌপ্যমুদ্রা ইত্যাদি পানিতে ভেসে উঠত বলে লোকমুখে বিভিন্ন মুখরোচক কাহিনী প্রচার হয়ে আসছে। সুরমা নদীর পূর্ব প্রান্তজুড়ে রয়েছে সুবিশাল পাথরের খনি। এখান থেকে প্রতিদিন

হাজার হাজার শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে। এখান থেকে আহরিত পাথর সারা দেশে সরবরাহ করা হয়।
এখানকার কোয়ারিতে আসার পথে আকর্ষণীয় অনেক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। নৌকায় আরোহণ করার পর পাহাড়, বাগান আর সবুজ বনানী নৌকা আরোহীর দৃষ্টি ও মন কেড়ে নেয়। নৌকায় বসে স্বচ্ছ পানির নিচ দিয়ে নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়।

লোভাছড়ায় আসার পথে পাওয়া যায় অসংখ্য টিলা। রাস্তার দুই পাশ ও টিলায় রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালি। এখানকার অরণ্যের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে খুবই ভালো লাগে। স্থানীয় বনবিভাগ এখানে একটি সামাজিক বন প্রতিষ্ঠা করেছে। স্থানীয়রা বলেন খুব সকালে হরিণ, খরগোশ, আর বনমোরগ চোখে পড়ে। আর রাতের আঁধারে শোনা যায় বাঘের গর্জন। বলা চলে- লোভাছড়া চা বাগান বন্যপ্রাণীদেরও অভয়াশ্রম। বাগান কর্তৃপক্ষের একটি বিশাল আকৃতির পোষা হাতি রয়েছে, যেটি সবসময় বাগানে অবাধ চলাফেরা করে। এখানকার অরণ্যে বাঘসহ বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু বাস করে। কখনো লোকালয়ে বাঘ চলে আসে। 

লোভাছড়ার পাশেই রয়েছে সুরমা, লোভা ও বরাক নদীর মিলনস্থল। তিনটি নদীর মিলন এখানে বদ্বীপের সৃষ্টি করেছে। নদীগুলোর মিলনস্থলে নদীর এক পাশের পানি খুবই স্বচ্ছ এবং অপর পাশের পানি খুবই ঘোলা। একই নদীতে দুই ধরনের পানি দেখে অনেকেই পুলকিত হন। 

সিলেটের বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী পর্যটন স্থান ছাড়াও বর্তমান সময়ে পর্যটক আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপিপাসুরা নতুন করে খুঁজে বের করছেন প্রকৃতির আরো সৃষ্টিকে। শুধু এ দেশের পর্যটক নন, সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে বিদেশি পর্যটকরাও ছুটে আসেন সিলেটে। ব্যাপক প্রচারণা না পাওয়া এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে সিলেটের পর্যটন স্পট হিসেবে সর্বশেষ সংযুক্ত হওয়া কানাইঘাটের লোভাছড়া। পর্যটন করপোরেশনের হস্তক্ষেপে লোভাছড়া হতে পারে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অন্যতম দর্শনীয় স্থান। সবুজে আচ্ছাদিত বন, স্বচ্ছ পানির নদী আর পাথর সমৃদ্ধ লোভাছড়া যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীকে বিমোহিত করবেই।


আবাসিক সুবিধা :
লোভাছড়ায় পর্যটকের জন্য থাকার কোনো সুব্যবস্থা না থাকলেও বাগান মালিক কর্তৃপক্ষের জন্য রয়েছে চারটি বাংলো। বাংলোগুলোর বাহ্যিক দৃশ্যগুলোও বেশ নান্দনিক। বাংলোর কাছাকাছি জায়গায় রয়েছে কয়েকটি কফি গাছ। আপনি লোভাছড়ায় রাত কাটাতে পারবেন না। এজন্য দিনে দিনেই ফিরতে হবে। থাকতে হবে সিলেট শহরে।

যেভাবে যাবেন :
লোভাছড়া যেতে হলে সিলেট শহরের কদমতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রথমে কানাইঘাট যেতে হবে। ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৪৫-৫০ টাকা। তারপর কানাইঘাট বাজার থেকে নৌকাঘাটে গিয়ে সুরমা নদীর পথ ধরে লোভাছড়ার উদ্দেশে যেতে হবে নৌকায় করে। জনপ্রতি ৩০ টাকা এবং রিজার্ভ নিলে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে লোভাছড়ার দূরত্ব মাত্র ৯ কিলোমিটার। উপজেলা সদর থেকে সড়ক ও নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়া যায়। লোভাছড়ায় যাতায়াতের রাস্তাটির অর্ধেকের চেয়ে বেশি কাঁচা হওয়ায় খুবই কষ্ট করে সেখানে পৌঁছাতে হয়। তাই নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়াই সহজ রাস্তা।